যেকোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সাফল্য ও টিকে থাকা নির্ভর করে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের উপর। উদ্যোক্তাকে ব্যবসায় পরিচালনার বিভিন্ন সময় স্থায়ী সম্পত্তি যেমন: জমি, দালানকোঠা, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ক্রয়, এসব স্থায়ী সম্পত্তি প্রতিস্থাপন, উৎপাদন পদ্ধতির আধুনিকায়ন, নতুন পণ্য বাজারে ছাড়া—এরকম অনেক দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এসব বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত কোম্পানির জন্য কতটুকু লাভজনক হবে বা আদৌ লাভজনক হবে কি না, সেজন্য এসব বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের সঠিক মূল্যায়নের জন্য কিছু পদ্ধতি বা নীতিমালা দরকার। অর্থায়নের যে সব পদ্ধতি বা নীতিমালা এসব দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করতে পারে, সে সম্পর্কে আমরা এ অধ্যায়ে জানতে পারব ।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
তিন বন্ধু রহিম, করিম ও শংকর আলাদা আলাদা ব্যবসা করেন। কিছু দিন ধরে রহিম তার মুদির দোকানের জন্য একটি ফ্রিজ কেনার চিন্তা-ভাবনা করছেন। ছয় মাস পূর্বে করিম একটি সেলাই মেশিন দিয়ে তার দর্জি ব্যবসা শুরু করে। অতিরিক্ত চাহিদার কথা চিন্তা করে বর্তমানে তিনি আরেকটি সেলাই মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত নিলেন। অন্যদিকে শংকর একটি আধুনিক সেলুন ব্যবসা শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র (হুইল চেয়ার) ও চুল কাটার মেশিন কেনার চিন্তা করছেন। এখানে মুদির দোকানের ফ্রিজ, দর্জি ব্যবসার সেলাই মেশিন এবং সেলুনের হুইল চেয়ার এবং চুল কাটার মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত একেকটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত। এসব দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য কতটুকু লাভজনক হবে বা আদৌ লাভজনক হবে কি না, সে জন্য ফিন্যান্সের একটি মূল্যায়ন প্রক্রিয়া প্রয়োজন। মূলধন বাজেটিং এরূপ একটি মূল্যায়ন প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে প্রত্যেকটি বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের বা প্রকল্পের আয়-ব্যয় প্রাক্কলন করতে হয়। আয়-ব্যয় প্রাক্কলন শেষে এসব সিদ্ধান্তের বা প্রকল্পের নিট নগদ প্রবাহ বা নিট মুনাফা নির্ধারণ করা হয়। এখানে আয় বলতে বিক্রয় থেকে অর্জিত অর্থ এবং ব্যয় বলতে কাচামাল খরচ, বিক্রয় খরচ এবং অবচয়সহ অন্যান্য খরচকে বুঝায়। আয় থেকে ব্যয় বাদ দিলে মোট মুনাফা এবং মোট মুনাফা থেকে কর বাদ দিলে নিট মুনাফা পাওয়া যায়। আবার নিট মুনাফার সাথে অবচয় যোগ করলে নগদ আন্তঃপ্রবাহ পাওয়া যায়। এই আন্তঃপ্রবাহের সাথে প্রারম্ভিক বিনিয়োগ বা নগদ বহিঃপ্রবাহের সাথে তুলনা করে। যদি আন্তঃপ্রবাহ বহিঃপ্রবাহ থেকে বেশি হয় তাহলে বিনিয়োগটি লাভজনক প্রতীয়মান হয় এবং গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়। এ প্রক্রিয়াকে মূলধন বাজেটিং প্রক্রিয়া বলা হয়।
অতএব বলা যায়, মূলধন বাজেটিং হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের সাথে জড়িত একটি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী সম্পত্তি যেমন: জমি, দালানকোঠা, যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ইত্যাদি ক্রয় থেকে শুরু করে এসব সম্পত্তির প্রতিস্থাপন, ব্যবসার সম্প্রসারণ যেমন: নতুন মেশিন স্থাপন, উৎপাদন পদ্ধতির আধুনিকায়ন এবং অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের আয়-ব্যয় প্রাক্কলন করে সম্ভাব্য লাভজনকতা বিশ্লেষণ করে তদনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
মূলধন বাজেটিং অর্থায়নের সাফল্যের চাবিকাঠি। মূলধন বাজেটিং বাস্তবসম্মত ও সঠিক হলে কারবার সরাসরি উপকৃত হয়। মূলধন বাজেটিং ব্যর্থ হলে কারবারটিও সাধারণত ব্যর্থ হয়। ব্যর্থতার দায়িত্ব অর্থ ব্যবস্থাপককে নিতে হয়। মূলধন বাজেটিং এত গুরুত্বপূর্ণ হবার কয়েকটি কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
১. মুনাফা-সংক্রান্ত : একটি প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য মুনাফা অর্জন। মুনাফা অর্জনে মূলধন বাজেটিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোম্পানি সাধারণত নগদ প্রবাহ পাবার আশায় তার দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগযোগ্য তহবিল উপার্জনকারী সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করে। ফলে প্রতিষ্ঠানের মুনাফা অনেকটা নির্ভর করে মূলধন বাজেটিং সিদ্ধান্তের উপর। মুদির দোকানি ফ্রিজ কেনার ফলে স্বাভাবিকভাবে ঠাণ্ডা পানীয় ও আইসক্রিম বিক্রয় বৃদ্ধি পাবে। ফলে কারবারের মুনাফা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু দোকানির আশেপাশের লোকজন যদি ঠাণ্ডা পানীয় ও আইসক্রিম খেতে অভ্যস্ত না, হয় সেক্ষেত্রে ফ্রিজ কেনার সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো সুবিধা আনবে না। সুতরাং, ভালো বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত যেমন কারবারটির জন্য পর্যাপ্ত আয় নিশ্চিত করতে পারে, অন্যদিকে ত্রুটিপূর্ণ বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের কারণে কারবারটি লোকসানের সম্মুখীন হতে পারে। তাই বলা যায়, মূলধন বাজেটিং সিদ্ধান্ত একটি কারবারের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
২. বিনিয়োগের বিশাল আকার : স্থায়ী সম্পত্তি ক্রয়, সংযোজন, আধুনিকায়ন এবং প্রতিস্থাপন প্রভৃতি মূলধন বাজেটিং সিদ্ধান্তের জন্য সাধারণত বড় অংকের তহবিল প্রয়োজন হয়। ফলে কোনো কারণে সিদ্ধান্তে ভুল হলে সেটি সংশোধন করার সাধারণত সুযোগ থাকে না এবং আর সংশোধনের সুযোগ থাকলেও বড় অংকের মাশুল দিতে হয়। উদাহরণস্বরূপ একটি কোম্পানি ঢাকার অদূরের একটি জায়গায় তাদের কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় এই ভেবে যে সেখানে সময়মতো বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সরবরাহ পাবে। কিন্তু কারখানা স্থাপনের পর দেখা গেল সরকার নতুন বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এমতাবস্থায় কারবারটি কারখানার উৎপাদন আরম্ভ করতে পারবে না। কিন্তু কারবারটিকে হয়তো এ কারণে ব্যাংক থেকে বড় আকারের ঋণ নিতে হয়েছে, যার সুদ ব্যাংকে নিয়মিত পরিশোধ করতে হবে। ফলে এরকম একটি ভুল সিদ্ধান্ত কারবারটিকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। অল্প টাকার ব্যাপার হলে অন্য কোথাও থেকে হয়তো, অর্থ সংকুলান করা যেত কিন্তু বড় বিনিয়োগ বলে তেমন সুযোগও নেই। এখন যদি প্রকল্পটি বিক্রয় করে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেখানে উপযুক্ত মূল্য পাওয়া যাবে না। কারণ প্রকল্পটি ইতিমধ্যে অলাভজনক প্রতীয়মান হয়েছে। সুতরাং কারবারটিকে বড় অংকের মাশুল দিতে হবে।
৩. ঝুঁকির ভিত্তিতে : মূলধন বাজেটিং-এর অধিকাংশ অনুমানই ভবিষ্যতের উপর নির্ভরশীল। একটি স্থায়ী সম্পত্তি যেমন: মেশিনটিতে বিনিয়োগ করা উচিত কি না এই সিদ্ধান্তটি নির্ভর করে ওই মেশিনটিতে উৎপাদিত পণ্য ভবিষ্যতে কত টাকা করে এবং কী পরিমাণে বিক্রয় হবে, কত টাকায় পণ্যটি উৎপাদন হবে ইত্যাদির উপর। ভবিষ্যতের এই তথ্য-উপাত্ত অনুমাননির্ভর, যা বাস্তবসম্মত নাও হতে পারে। সুতরাং, মূলধন বাজেটিং সর্বদাই ঝুঁকিযুক্ত সিদ্ধান্ত। যেমন: বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের আশংকা করে ছাতা প্রস্তুতকারী তার ব্যবসার সম্প্রসারণ করে ও উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নতুন মেশিন কিনে অধিক ছাতা উৎপাদন করে। উৎপাদনকারীর প্রাক্কলন অনুযায়ী বর্ষাকালে বৃষ্টি না হলে আশানুরূপ ছাতার বিক্রি হবে না। ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে ঝুঁকি নিরূপণ ও ঝুঁকির গ্রহণযোগ্যতা যাচাই প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে মূলধন বাজেটিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের সব ক্ষেত্রেই মূলধন বাজেটিং প্রয়োগ করা হয়। স্থায়ী সম্পত্তি ক্রয় থেকে শুরু করে, ব্যবসার প্রসার, ব্যবসার আধুনিকায়ন, স্থায়ী সম্পত্তির প্রতিস্থাপন এবং নতুন পণ্য বাজারে ছাড়া সংক্রান্ত সকল প্রকার বিনিয়োগ পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে মূলধন বাজেটিং-এর প্রয়োগ রয়েছে। এবার আমরা মূলধন বাজেটিং প্রয়োগের কয়েকটি জনপ্রিয় ক্ষেত্র আলোচনা করব।
স্থায়ী সম্পত্তির ক্রয় : যেকোনো কোম্পানি নতুন ব্যবসায় শুরু করতে গেলে স্থায়ী সম্পত্তি যেমন: জমি, দালানকোঠা, যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ইত্যাদি ক্রয় করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, মুদি দোকানিকে তার ব্যবসায় শুরু করার সময় ফ্রিজ, তাকিয়া, ওজন মাপার স্কেল ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। রেস্টুরেন্ট মালিককে তার ব্যবসায় শুরুর সময় চেয়ার, টেবিল, হাঁড়ি-পাতিল, রান্নার অন্যান্য সরঞ্জাম ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হয় অনুরূপভাবে বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি, দালানকোঠা, কারখানা নির্মাণ, মেশিনারিজ ক্রয় ইত্যাদি সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যেকোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের এসব সম্পত্তি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মূলধন বাজেটিং প্রয়োগ করা হয়। কারবার চলতে চলতে বিভিন্ন সময়ে এসব স্থায়ী সম্পত্তি অকেজো বা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমতাবস্থায় এসব স্থায়ী সম্পত্তি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রেও মূলধন বাজেটিং প্রয়োগ করে কোম্পানি সিদ্ধান্ত নেয় ।
ব্যবসার পণ্য উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে সম্প্রসারণ : চলমান কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তার ব্যবসায় শুরু করার পর উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে। উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে কোম্পানির নতুন মেশিন ক্রয়ের প্রয়োজন হয়। উদাহরণস্বরূপ দর্জির দোকানি তার বর্তমান ব্যবসায় ১টি সেলাই মেশিন থাকা সত্ত্বেও ভোক্তাদের ঈদের চাহিদার কথা চিন্তা করে নতুন আর একটি সেলাই মেশিন কেনার চিন্তা করতে পারে। মুদির দোকানি তার দোকানে ফ্রিজ থাকা সত্ত্বেও আরেকটি ফ্রিজ কেনার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এজন্য কোম্পানিকে নতুন মেশিন ক্রয় বাবদ কত ব্যয় হবে, কারবারের আয় তাতে করে কত বাড়বে ইত্যাদি প্রাক্কলন করে মূলধন বাজেটিং প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় ।
পণ্য বৈচিত্র্যায়ণ: কোম্পানি তার ব্যবসার সম্প্রসারণের জন্য চলমান পণ্যের পাশাপাশি নতুন পণ্য বাজারে ছাড়ার প্রয়োজন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো কোম্পানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনয়নের জন্য আমের জুসের পাশাপাশি কমলার জুস বা আপেলের জুস বাজারে ছাড়ার চিন্তা করতে পারে। নতুন পণ্য বাজারে ছাড়ার ক্ষেত্রে নতুন পণ্যের আয়ুষ্কাল, পণ্যের উৎপাদন খরচ, বাজার চাহিদা, পরিচালনা খরচ এবং সম্ভাব্য আয় প্রাক্কলন করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এক্ষেত্রে মূলধন বাজেটিং-এর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।
প্রতিস্থাপন ও আধুনিকায়ন : ব্যবসার প্রয়োজনে উৎপাদন পদ্ধতির প্রতিস্থাপন ও আধুনিকায়নের প্রয়োজন হয়। উদাহরণস্বরূপ, দর্জির দোকানি পা-চালিত সেলাই মেশিনের পরিবর্তে বিদ্যুৎ চালিত সেলাই মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অন্যদিকে চুল কাটার সেলুনের মালিক তার দোকানকে ভেতরের সাজসজ্জা পরিবর্তন করে এসি সেলুন বানানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এক্ষেত্রে প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে উৎপাদন খরচ কমানো এবং এর মাধ্যমে ব্যবসার লাভ বৃদ্ধি করা। এক্ষেত্রে কোম্পানির পুরাতন উৎপাদন পদ্ধতির সাথে নতুন পদ্ধতির তুলনা প্রয়োজন হয়। উভয় পদ্ধতিতে কোম্পানি আয়, পরিচালনা ব্যয়, আয়ুষ্কাল ইত্যাদি হিসাব করে নিট নগদ প্রবাহ নির্ধারণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। অতএব, উৎপাদন পদ্ধতির প্রতিস্থাপন ও আধুনিকায়নে মূলধন বাজেটিংয়ের প্রয়োগ লক্ষ করা যায়।
দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে মূলধন বাজেটিং-প্রক্রিয়া প্রয়োগে জড়িত ধাপগুলো নিম্নরূপ :
ক) নগদ প্রবাহ প্রাক্কলন
খ) বাট্টা হার নির্ধারণ
গ) মূলধন বাজেটিং পদ্ধতি নির্বাচন ও প্রয়োগ
ক) নগদ প্রবাহ প্রাক্কলন : যেকোনো দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত যেমন: স্থায়ী সম্পত্তি ক্রয়, ব্যবসার সম্প্রাসারণ, উৎপাদন পদ্ধতির যান্ত্রিকীকরণে এবং অন্যান্য সিদ্ধান্তের সাথে নগদ প্রবাহ জড়িত। মূলধন বাজেটিং-প্রক্রিয়া প্রয়োগের প্রথম ধাপ হচ্ছে নগদের আন্তঃপ্রবাহ ও বহিঃপ্রবাহ প্রাক্কলন করা। প্রতিষ্ঠানের নগদ প্রবাহ করতে প্রতিষ্ঠানকে বিক্রয় পূর্বানুমান, চলতি খরচ পূর্বানুমান, মূলধনি ব্যয় এবং অন্যান্য ব্যয় নির্ধারণ করতে হবে। বিক্রয় থেকে প্রতিষ্ঠানের নগদ আন্তঃপ্রবাহ ঘটে এবং চলতি খরচ, মূলধনি ব্যয় এবং অন্যান্য খরচ পূর্বানুমান থেকে নগদ বহিঃপ্রবাহ ঘটে। এখানে বিক্রয় অনুমান, চলতি খরচ, স্থায়ী খরচ প্রত্যেকটি বিষয় অতি সতর্কতার সাথে নির্ধারণ করতে হয়। আগেই বলেছি একটি প্রতিষ্ঠানের মোট বিক্রয় অনুমান করতে হলে প্রতিটি পণ্যের ভবিষ্যতে বিক্রয়মূল্য এবং প্রতিবছর কতগুলো পণ্য বিক্রি হবে তা পূর্বানুমান করতে হয়। এগুলো পূর্বানুমানের পর প্রতিবছর বিক্রি থেকে মোট অর্জিত আয় পাওয়া যায় এই অর্জিত আয় থেকে নগদ আন্তঃপ্রবাহ পাওয়া যায়। অতএব বলা যায়, নগদ প্রবাহের সঠিক প্রাক্কলন নির্ভর করে পণ্যের ভবিষ্যৎ বছরগুলোতে বিক্রয়মূল্য এবং কতগুলো পণ্য বিক্রয় হবে তার উপর। এ কারণে, ভবিষ্যৎ বিক্রয়মূল্য অনুমানে বা পণ্য বিক্রির সংখ্যা অনুমানে ভুল হলে সেটির প্রভাব নগদ প্রবাহকে প্রভাবিত করে। অনুরূপভাবে প্রতিষ্ঠানের মোট খরচের মাধ্যমে নগদ বহিঃপ্রবাহ ঘটে। একটি প্রতিষ্ঠানের চলতি খরচ এবং স্থায়ী খরচ মিলে মোট খরচ হয়। চলতি খরচ বলতে কাঁচামাল ক্রয় বাবদ খরচ, কর্মচারীদের বেতন এবং অন্যান্য পরিচালনা খরচ এবং স্থায়ী খরচ বলতে অফিস ভাড়া, বিমা খরচ, অবচয়সহ অন্যান্য খরচকে বুঝানো হয়। বিক্রয় অনুমানের মতো প্রত্যেক চলতি খরচ এবং স্থায়ী খরচ পূর্বানুমানে অতি সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। কোনো কারণে এসব খরচ অনুমানে ভুল হলে মূলধন বাজেটিং ভুল সিদ্ধান্ত দিতে পারে, যে কারণে প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
খ) বাট্টা হার : নগদ প্রবাহ নির্ধারণ করার পর সেগুলোকে নগদ মূল্যে রূপান্তর করার জন্য বাট্টা হার প্রয়োজন হয়। অর্থের সময় মূল্য অধ্যায়ে তোমরা জেনেছ যে ভবিষ্যৎ বছরগুলোতে আগত নগদ প্রবাহের পরিমাণ সমান হলেও সেগুলোর বর্তমান মূল্য সমান হয় না। অর্থের সময়মূল্য অনুযায়ী নগদ প্রবাহ যত দেরিতে পাওয়া যায়, সেটির বর্তমান মূল্য তত কম। বিনিয়োগ সুযোগ বা প্রকল্প থেকে যেহেতু বেশ কয়েক বছর ধরে নগদ প্রবাহ পাওয়া যায়, সেহেতু মূলধন বাজেটিং-এর মাধ্যমে সঠিক বিনিয়োগ সুযোগ নিতে হলে ভবিষ্যতে আগত নগদ প্রবাহগুলোর বর্তমান মূল্য নির্ণয় করতে হয়। বাট্টাকরণ প্রক্রিয়ায় ভবিষ্যতের নগদ প্রবাহকে বর্তমান মূল্যে রূপান্তর করা হয়। এ কারণে বাট্টা হারের প্রয়োজন হয়। সাধারণত প্রতিষ্ঠানের মূলধন খরচকে মূলধন বাজেটিং-প্রক্রিয়ার বাট্টা হার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। মূলধন ব্যয় সম্পর্কে তোমরা পরের অধ্যায়ে বিস্তারিত জানতে পারবে। আয়-ব্যয় প্রাক্কলনের পূর্বেই বাট্টা হার নির্ধারণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গ) মূলধন বাজেটিং পদ্ধতির প্রয়োগ : নগদ প্রবাহ প্রাক্কলন এবং বাট্টা হার নির্ধারণের পর মূলধন বাজেটিং পদ্ধতি নির্বাচন করতে হয়। বিনিয়োগ সুযোগ বা প্রকল্প মূল্যায়নের জন্য মূলধন বাজেটিং-এর বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। প্রত্যেকটি পদ্ধতি সমানভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। প্রত্যেকটি পদ্ধতির কিছু সুবিধা- অসুবিধা রয়েছে। বিনিয়োগ সুযোগ বা প্রকল্পের ধরন, ঝুঁকি এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে সঠিক পদ্ধতিটি নির্বাচন করতে হয়।
প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে মূলধন বাজেটিং-এর বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত আছে। প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ এবং সার্বিকভাবে লাভজনক বিনিয়োগ বা প্রকল্প নির্বাচন করাই মূলধন বাজেটিং পদ্ধতিসমূহের কাজ। উদাহরণ: দর্জির দোকানির সেলাই মেশিন, মুদির দোকানির ফ্রিজ এবং চুল কাটার সেলুনে মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত ব্যবসার জন্য লাভজনক হবে কি না, এসব সিদ্ধান্তে মূলধন বাজেটিং পদ্ধতি সঠিক নির্দেশনা দিতে পারে। মূলধন বাজেটিং-এর পদ্ধতিসমূহ নিম্নরূপ:
১) গড় মুনাফার হার পদ্ধতি (Accounting rate of return method)
২) পে-ব্যাক সময় পদ্ধতি (Pay back period method )
৩) নিট বর্তমান মূল্য পদ্ধতি (Net present value method )
৪) অভ্যন্তরীণ মুনাফার হার পদ্ধতি (Internal rate of return method)
মূলধন বাজেটিং-এর একটি সহজ পদ্ধতি হলো গড় মুনাফার হার পদ্ধতি। প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি গড় মুনাফা হার নির্ধারণে ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে প্রত্যাশিত নগদ প্রবাহের পরিবর্তে প্রত্যাশিত নিট মুনাফাকে বিবেচনা করা হয়। তোমরা জেনেছ যে বিক্রয় থেকে করসহ সব খরচ বাদ দিলে নিট মুনাফা পাওয়া যায়। প্রত্যাশিত বার্ষিক গড় নিট মুনাফাকে গড় বিনিয়োগ দিয়ে ভাগ করলে গড় মুনাফার হার পাওয়া যায়। অর্থাৎ
গড় মুনাফার হার= (গড় নিট মুনাফা /গড় বিনিয়োগ) ×১০০
এ পদ্ধতিতে প্রতিবছরের প্রত্যাশিত মোট মুনাফাকে মোট বছরের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে গড় মুনাফা এবং বিনিয়োগকে ২ দিয়ে ভাগ করলে গড় বিনিয়োগ পাওয়া যাবে।
সিদ্ধান্ত নীতি
গড় মুনাফা হার পরিমাপ করার সূত্রে তেমন জটিলতা না থাকার কারণে এটি বুঝা সহজ। আবার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণী থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পাওয়া যায় বলে এটি অনেকের কাছে জনপ্রিয়। তবে পদ্ধতিটির কিছু অসুবিধা রয়েছে। প্রথমত, গড় মুনাফা পদ্ধতি নগদ প্রবাহের পরিবর্তে নিট মুনাফা ব্যবহার করে, নিট মুনাফার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে বলে অনেকে পদ্ধতিটিকে নির্ভরযোগ্য মনে করে না। দ্বিতীয়ত, পদ্ধতিটি অর্থের সময় মূল্যকে বিবেচনা করে না। যেকোনো বিনিয়োগ সুযোগ বা প্রকল্পের নগদ প্রবাহ ভবিষ্যৎ বছরগুলো থেকে আসে। যেহেতু আজকের ১ টাকা ভবিষ্যতের ১ টাকার সমান নয়, ভবিষ্যতে আগত নগদ প্রবাহের মূল্য সমান হয় না। কিন্তু গড় মুনাফা পদ্ধতি সব নগদ প্রবাহ সমমূল্যের বিবেচনা করে, এটি পদ্ধতিটির সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা। এখন আমরা উদাহরণের মাধ্যমে গড় মুনাফার প্রয়োগ সম্পর্কে পরিচিত হব।
উদাহরণ : মনে কর, তোমার বাবা ক এবং খ নামে দুটি বিনিয়োগ প্রকল্পে বিনিয়োগের চিন্তাভাবনা করছেন। প্রকল্প দুটির বিস্তারিত বিবরণ নিচে দেওয়া হলো।
প্রকল্প-ক : প্রকল্পের মেয়াদকাল ৩ বছর এবং প্রাথমিক মূলধন হিসেবে ১ কোটি টাকা দরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করলে আগামী ৩ বছর প্রাক্কলিত বিক্রয় যথাক্রমে ৮ লক্ষ টাকা, ১৯৯ লক্ষ টাকা ও ৮০ লক্ষ টাকা এবং চলতি খরচ বিক্রয়ের ৪০ শতাংশ অনুমান করা হয়। অতএব, ৪০ শতাংশ হারে আগামী তিন বছর প্রচলিত চলতি খরচ যথাক্রমে ৩.২০ লক্ষ, ৭৯ লক্ষ টাকা এবং ৩২ লক্ষ টাকা হয়। এর মধ্যে কাঁচামালের খরচ, শ্রমিকের মজুরি, বিদ্যুৎ বিল ইত্যাদি আছে। এর পরে আসছে স্থায়ী খরচ। স্থায়ী খরচ উৎপাদন বা বিক্রয়ের পরিবর্তনে পরিবর্তিত হবে না যেমন, বিল্ডিং ভাড়া। চলতি খরচের পাশাপাশি আগামী তিন বছরে প্রতিবছর ৫ লক্ষ টাকা করে স্থায়ী খরচ অনুমান করা হয়। এর পরে আসছে অবচয় ব্যয়। প্রত্যেক প্রকল্পে মেশিনপত্র বাবদ কিছু বিনিয়োগ করতে হয়। এই প্রকল্পে যে ১ কোটি টাকা বিনিয়োগ দেখান হয়েছে, সেটা মেশিনপত্র বাবদ ব্যয়। এটা থেকেই অবচয় বের করতে হয়। বিনিয়োগের পরিমাণকে বিনিয়োগের আয়ুষ্কাল দিয়ে ভাগ করে অবচয় পাওয়া যাবে। যেহেতু প্রকল্পটি থেকে বিক্রয় পাওয়া যাবে মাত্র ৩ বছর সুতরাং প্রকল্পটির আয়ুষ্কাল মাত্র ৩ বছর। ১ কোটি টাকা বিনিয়োগকে ৩ দিয়ে ভাগ করে প্রতিবছরের অবচয় দেখান হয়েছে ৩৩.৩ লক্ষ টাকা। বিক্রয়লব্ধ অর্থ থেকে স্থায়ী ও চলতি ব্যয় এবং অবচয় বাদ দিয়ে করযোগ্য বের করা যায় করের হার ৩০ শতাংশ। প্রথম বছর লাভের বদলে ক্ষতি হচ্ছে ৩৩.৫ লক্ষ টাকা। প্রকল্পটিতে ২য় ও ৩য় বছরে লাভ হবে প্রায় ৮১.১ ও ৯.৭ লক্ষ টাকা। এখানে লক্ষণীয় যে লাভ হলে যেমন ৩০ শতাংশ হারে কর বাদ দেয়া হচ্ছে ১ম বছরের ক্ষতির উপরেও কর হিসাব করে ক্ষতি কমান হচ্ছে।
এর অনুমানটি হচ্ছে, আমরা ধরে নিচ্ছি প্রতিষ্ঠানটির অন্যান্য প্রকল্প থেকে করযোগ্য আয় হয় এবং এই প্রকল্পে যদি ক্ষতি হয়, তবে প্রতিষ্ঠানটির সর্বমোট প্রদেয় কর একই হারে কমে যায়। এভাবে হিসাব করে ক-প্রকল্প থেকে তিন বছরে যে নিট মুনাফা প্রত্যাশা করা হচ্ছে তা যথাক্রমে ১ম বছরে নিট ক্ষতি ২৩.৫ লক্ষ টাকা, ২য় বছরে নিট লাভ ৫৬.৮০ লক্ষ টাকা ও ৩য় বছরে নিট লাভ ৬.৮ লক্ষ টাকা।
প্রকল্প-খ : প্রকল্প 'ক' এর ন্যায় প্রকল্প 'খ' এর আয়ুষ্কাল ৩ বছর এবং প্রাথমিক বিনিয়োগ ১ কোটি টাকা অনুমান করা হয়। আগামী তিন বছরে প্রকল্পটি থেকে যথাক্রমে ১৫১ লক্ষ টাকা, ১১০ লক্ষ টাকা এবং ৪৯ লক্ষ টাকা বিক্রয় পূর্বানুমান করা হয়। চলতি খরচ বিক্রয়ের ৩০ শতাংশ হারে প্রাক্কলন করা হয়। চলতি খরচের পাশাপাশি স্থায়ী খরচ বাবদ প্রতিবছর ২০ লক্ষ টাকা এবং অবচয় বাবদ প্রতিবছর ৩৩.৩ লক্ষ টাকা নির্ধারণ করা হয়। প্রকল্প ক-এর ন্যায় প্রকল্প খ-এর কর হার ৩০% পূর্বানুমান করা হয়।
উল্লিখিত তথ্যের ভিত্তিতে প্রকল্প দুটির গড় মুনাফা হার নিম্নরূপে নির্ধারণ করা যায়:
প্রকল্প-ক
প্রারম্ভিক মূলধন | পরিমাণ (লক্ষ টাকায়) | ||
বছর১ | বছর২ | বছর৩ | |
বিক্রয় |
৮.০০ | ১৯৯.০০ | ৮০.০০ |
চলতি ব্যয় (বিক্রয়ের ৪০% ) |
৩.২০ | ৭৯.৬০ | ৩২.০০ |
স্থায়ী খরচ |
৫.০০ | ৫.০০ | ৫.০০ |
অবচয় |
৩৩.৩০ | ৩৩.৩০ | ৩৩.৩০ |
মুনাফা/(ক্ষতি) |
(৩৩.৫০) | ৮১.১০ | ৯.৭০ |
কর | লোকসানের ক্ষেত্রে কোন কর নির্ধারণের প্রয়োজন নেই | ২৪.৩০ | ২.৯০ |
নিট মুনাফা-নিট ক্ষতি | (৩৩.৫০) | ৫৬.৮০ | ৬.৮০ |
এখানে, গড় মুনাফা= =১৩ লক্ষ টাকা
গড় বিনিয়োগ = = ৫০
গড় মুনাফার হার = = ২৬%
প্রকল্প-খ
বছর ১(লক্ষ টাকা) | বছর ২(লক্ষ টাকা) | বছর ৩(লক্ষ টাকা) | |
বিক্রয় | ১৫১.০০ | ১১০.০০ | ৪৯.০০ |
চলতি খরচ | ৪৫.৩০ | ৩৩.০০ | ১৪.৭০ |
স্থায়ী খরচ | ২০.০০ | ২০.০০ | ২০.০০ |
অবচয় | ৩৩.৩০ | ৩৩.৩০ | ৩৩.৩০ |
করযোগ্য মুনাফা | ৫২.৪০ | ২৩.৭০ | (১৯.০০) |
কর | ১৫.৭০ | ৭.১০ | - |
নিট মুনাফা | ৩৬.৭০ | ১৬.৬০ | (১৯.০০) |
এখানে,
গড় মুনাফা= = ১৩ লক্ষ টাকা
গড় বিনিয়োগ= =৫০ লক্ষ টাকা
সুতরাং, গড় মুনাফার হার = =২৬%
লক্ষণীয় যে দুটি প্রকল্পে গড় মুনাফার হার সমান, এখানে একটি প্রকল্পের গড় মুনাফার আরেকটির চেয়ে বেশি হলে প্রতিষ্ঠানটি যে প্রকল্পের গড় মুনাফার হার বেশি, সেটি গ্রহণ করত। বর্তমান অবস্থায় গড় মুনাফার হার অনুযায়ী, প্রত্যেকটি প্রকল্পই প্রতিষ্ঠানের জন্য সমান লাভজনক। এমতাবস্থায় প্রতিষ্ঠান যেকোনোটিই গ্রহণ করতে পারে।
ব্যবসায় বা প্রকল্পে বিনিয়াগকৃত টাকা কত দিনে ফেরত আসবে তা পে-ব্যাক সময় পদ্ধতি নির্দেশ করে। পে-ব্যাক সময় পদ্ধতি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত বা প্রকল্প মূল্যায়নের একটি সহজ ও জনপ্রিয় পদ্ধতি। ব্যবসায় বিনিয়োগ বা প্রকল্প থেকে আগত আন্তঃপ্রবাহগুলো যদি সমান হয়, তবে বিনিয়োগকৃত টাকাকে বার্ষিক নগদ প্রবাহ দিয়ে ভাগ করলে পে-ব্যাক সময় নির্ণয় করা যায়। অর্থাৎ
পে-ব্যাক সময়= বিনিয়োগ/বার্ষিক নগদ প্রবাহ
মনে করি, দর্জির দোকানির মেশিন কিনতে ১৫,০০০ টাকা প্রয়োজন। ক্রয়কৃত মেশিন ব্যবহার করে সে তার ব্যবসা থেকে আগামী ৪ বছর বার্ষিক ৫০০০ টাকা আন্তঃপ্রবাহ নিশ্চিত করতে পারবে। এক্ষেত্রে পে-ব্যাক সময় হবে :
পে-ব্যাক সময়= = ৩ বছর
ব্যবসায় বা প্রকল্প থেকে আগত আন্তঃপ্রবাহ অনেক সময় সমান নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে ক্রমযোজিত নগদ প্রবাহ ব্যবহার করে পে-ব্যাক সময় নির্ণয় করা হয়। অর্থাৎ, নগদ আন্তঃপ্রবাহগুলোকে ক্রমান্বয়ে যোগ করা হয় যতক্ষণ না পর্যন্ত ক্রমযোজিত নগদ প্রবাহ বিনিয়োগকৃত মূলধনের সমান হয়।
গড় মুনাফার হার পদ্ধতিতে ব্যবহৃত উদাহরণে ৩ বছরের নিট মুনাফা ফলক্রমে -২৩.৫, ৫৬.৮ এবং ৬.৮। পে-ব্যাক এবং মূলধন বাজেটিং-এর অন্যান্য পদ্ধতিতে মুনাফার পরিবর্তে নগদ প্রবাহ ব্যবহার করা হয়। সাধারণত নিট মুনাফার সাথে অবচয় যোগ করলে নগদ প্রবাহ পাওয়া যায়। অতএব, পূর্বের উদাহরণে বর্ণিত প্রকল্প ‘ক’-এর নির্ণীত নিট মুনাফার সাথে অবচয় যোগ করে নিম্নরূপে নগদ প্রবাহ নির্ণয় করা যায়।
বছর ১ | বছর ২ | বছর ৩ | |
নিট মুনাফা | (২৩.৫) | ৫৬.৮ | ৬.৮ |
যোগঃ অবচয় | ৩৩.৩ | ৩৩.৩ | ৩৩.৩ |
নগদ প্রবাহ (প্রায়) | ১০ | ৯০ | ৪০ |
উপরের সারণিতে নির্ণীত নগদ প্রবাহ ব্যবহার করে প্রকল্পটির পে-ব্যাক সময় হবে নিম্নরূপ ।
বছর | নগদ প্রবাহ | ক্রমযোজিত নগদ প্রবাহ |
০ | -১০০ | -১০০ |
১ | ১০ | -৯০ |
২ | ৯০ | ০ |
৩ | ৪০ | ৪০ |
উপরের ছক থেকে লক্ষণীয় যে প্রথম দুই বছরে বিনিয়োগকৃত টাকা পুরোটা ফেরত আসে। ফলে প্রকল্পের পে-ব্যাক সময় হবে ২ বছর।
আবার গড় মুনাফার হার পদ্ধতিতে প্রকল্প ‘খ’-এর নির্ণীত নিট মুনাফার সাথে অবচয় যোগ করলে প্রকল্প ‘খ’- এর নগদ প্রবাহ পাওয়া যাবে।
বছর ১ (লক্ষ টাকায়) | বছর ২ (লক্ষ টাকায়) | বছর ৩ (লক্ষ টাকায়) | |
নিট মুনাফা | ৩৬.৭ | ১৬.৬ | (১৩.৩) |
অবচয় | ৩৩.৩ | ৩৩.৩ | ৩৩.৩ |
নগদ প্রবাহ | ৭০ | ৫০ | ২০ |
সারণিতে নির্ণীত নগদ প্রবাহ ব্যবহার করে প্রকল্প ‘খ’-এর পে-ব্যাক সময় নিম্নরূপে নির্ণয় করা যায় ।
বছর | নগদ | ক্রমযোজিত নগদ প্রবাহ |
০ | -১০০ | -১০০ |
১ | ৭০ | -৩০ |
২ | ৫০ | ২০ |
৩ | ২০ | ৪০ |
উপরে ছক থেকে লক্ষণীয় যে প্রথম বছরে বিনিয়োগকৃত টাকার ৭০ টাকা ফেরত আসে। দ্বিতীয় বছরের আন্তঃপ্রবাহ হবে ৫০ টাকা কিন্তু প্রারম্ভিক বিনিয়োগ ফেরত পেতে মাত্র ৩০ টাকা দরকার । অতএব, ৩০ টাকা ফেরত আসতে সময় দরকার বছর। নিচে সূত্রের সাহায্যে নির্ণয় করা হলো :
পে-ব্যাক সময় = ১বছর+ বছর
= বছর
= ১.৬ বছর
সিদ্ধান্ত নীতি
পে-ব্যাক সময় পদ্ধতিতে, যে প্রকল্পের পে-ব্যাক সময় যত কম, সে প্রকল্পটি তত গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। অনুরূপভাবে যে প্রকল্পের পে-ব্যাক সময় যত বেশি, সে প্রকল্পটি তত বেশি অগ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
আবার যদি প্রতিষ্ঠানের হাতে এক বা একাধিক বিনিয়োগ সুযোগ বা প্রকল্প থাকে তাহলে বিনিয়োগ সুযোগগুলোকে বা প্রকল্পগুলোকে পে-ব্যাক সময় অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে সাজানো হয়। পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠানের তহবিলের পর্যাপ্ততা সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সুযোগ বা প্রকল্প গ্রহণ করা হয় এবং অবশিষ্টগুলোকে বাতিল করা হয় ।
প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহৃত পে-ব্যাক সময় নিধারণ করে থাকে। কোম্পানির কর্মকর্তারা বিভিন্ন বিষয় যেমন: বিনিয়োগের ধরন (স্থায়ী সম্পত্তির ক্রয়, ব্যবসার সম্প্রসারণ, উৎপাদন পদ্ধতির প্রতিস্থাপন বা আধুনিকায়ন), বিনিয়োগ বা প্রকল্প ঝুঁকি এবং অন্যান্য বিষয় চিন্তাভাবনা করে এটি নির্ধারণ করেন।
পে-ব্যাক পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা
পে-ব্যাক পদ্ধতি মূলধন বাজেটিং-এর সবচেয়ে সরল ও জনপ্রিয় পদ্ধতি। এর জনপ্রিয়তার কারণ প্রথমত : এই পদ্ধতি সহজবোধ্য ও সহজ। তবে এর কিছু অসুবিধাও আছে। এখানে কিছু অসুবিধা তুলে ধরা হলো ।
১. পে-ব্যাক মূলত কোনো লাভের হার নয়। এটা একটি সময়কাল,যখন বিনিয়োজিত মূলধন ফেরত আসবে বলে আশা করা হয়। পে-ব্যাক সময়কাল অতিবাহিত হলে প্রতিষ্ঠানটির কোনো লাভ হবে না প্রতিষ্ঠানটি কেবল ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে।
২. যদি দুই বা ততোধিক প্রকল্প থাকে, তবে যার পে-ব্যাক কাল কম; তা গ্রহণ করা হয় যদি একটি প্রকল্প থাকে তাহলে এটি গ্রহণযোগ্য কি না তা এই পদ্ধতির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।
৩. পে-ব্যাক কালের বাইরের নগদ প্রবাহ গণনা করা হয় না। উপরের প্রকল্প ক-তে পে-ব্যাক ছিল ২ বছর। এমতাবস্থায় ৩য় বছরে যদি প্রকল্পটি একটি বিশাল অংকের নগদ প্রবাহ দেয়, তবুও পে-ব্যাক কাল ২ বছরই থাকবে।
৪. পে-ব্যাক অর্থের সময়মূল্য বিবেচনা করে না। অর্থের সময়মূল্য অধ্যায়ে আমরা জেনেছি, আগামী বছরের ১০০ টাকা ৫ বছর পরের ১০০ টাকা থেকে অধিকতর মূল্যবান, কিন্তু পে-ব্যাক অর্থের সময়মূল্য বিবেচনা করে না। এখানে আগামী বছরের ১০০ টাকা এবং ৫ বছর পরের ১০০ টাকা সমান মূল্যবান মনে করা হয়। এটি একটি সমস্যা।
পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদগুলোতে তোমরা গড় মুনাফার হার পদ্ধতি এবং পে-ব্যাক সময় পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছ। তবে মূলধন বাজেটিং পদ্ধতিগুলোর মধ্যে উল্লিখিত দুটি পদ্ধতির তুলনায় নিট বর্তমান মূল্য পদ্ধতি ও অভ্যন্তরীণ মুনাফার হার পদ্ধতি বহুল প্রচলিত হিসাবে স্বীকৃত। বিশেষ করে অর্থের সময় মূল্য বিবেচনা করে বিধায় পদ্ধতি দুটি অনেকের কাছে জনপ্রিয়। পরবর্তী শ্রেণিগুলোতে তোমরা পদ্ধতি দুটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবে।
আরও দেখুন...